মঙ্গলবার, ১২ জানুয়ারী, ২০২১

জামদানি - বাঙ্গালীর অমলিন এক ঐতিহ্য

 

জামদানি শাড়ি বাঙ্গালির এক অমলিন ঐতিহ্যের নাম  জামদানি শাড়ির সৌন্দর্য্য সবার জানা। বাঙ্গালী নারী মানেই জামদানি শাড়ির প্রতি অন্যরকম এক ভালবাসা। অথচ বেশিরভাগ নারীই জানেন না জামাদানির জন্মের গল্প। জানেন না কিভাবে বেশিদিন টিকিয়ে রাখা যায় পছন্দের জামদানিটাকে। চলুন জেনে নেয়া যাক জামদানি নিয়ে টুকিটাকি কিছু গল্প।

জামদানির ইতিকথাঃ

প্রাচীনকালে তাঁতের মেশিনে কার্পাস তুলা দিয়ে বোনা হতো মিহি মসলিন শাড়ি। তাতে জ্যামিতিক নানা ডিজাইন করা হতো। আর সেই মসলিনের উত্তরসূরীর নাম রাখা হয় "জামদানি" শাড়ি। জামদানির সঠিক নামকরণ সম্পর্কে জানা যায়নি তবে তোফায়েল আহমেদ এর মতে ফারসি শব্দ  'জাম' অর্থ কাপড় আর 'দানা' অর্থ বুটি। অর্থাৎ জামদানি অর্থ বুটিদার কাপড়।  আবার আরেকটি মতে, ফারসিতে জাম অর্থ এক ধরনের উৎকৃষ্ট মদ এবং দানি অর্থ পেয়ালা। জাম পরিবেশনকারী ইরানী সাকীর পরনের মসলিন থেকে জামদানি নামের উৎপত্তি ঘটেছে।

জামদানি তৈরীর গল্পঃ

জামদানি মসলিনের সূক্ষ্মতা নির্ভর করে এর এর সুতা কাটা এর বুনন কৌশল এর উপর। তাঁতীরা ভোরবেলাকেই সঠিক সময় হিসেবে বেছে নেন বুননের জন্য। কারণ এসময় বাতাসে আর্দ্রতা কম থাকে।সুতা কাটতে ব্যবহার করা হতো টাকু,বাঁশের ঝুড়ি, শঙ্খ পাথরের বাটি। মাড় হিসেবে ব্যবহার করতো খই, বার্লি বা ভাত। প্রথমে তাদের সুতা রঙ করতে হতো। ভাল জামদানির জন্য ২০০-২৫০ নম্বর সুতা ব্যবহার করা হতো এবং লতাপাতা, ফুল ফল ইত্যাদির রস ব্যবহার করতো।জমিনের সুতার তুলনায় নকশার সুতা একটু মোটা হয় তাতে নকশাগুলো ভালো করে ফুটে উঠে। প্রথমদিকে শুধু ধূসর জমিনে কাজ করা হলেও পরে অন্য রঙের জমিনেও কাজ করা হয়।

জামদানির নানা নামঃ

নকশা অনুযায়ী বিভিন্ন জামদানি বিভিন্ন নামে পরিচিত আছে। চলুন জেনে নিই তাদের নাম  - পান্না হাজার, দুবলি জাল, বুটিদার, তেরছা, জালার, ডুরিয়া, চারকোণা, ময়ূর প্যাঁচ, কলমিলতা, পুঁইলতা, কচুপাতা, কাটিহার, কলকা পাড়, আঙুরলতা, সন্দেশ পাড়, প্রজাপতি পাড়, দুর্বা পাড়, শাপলাফুল, বাঘনলি, জুঁইবুটি, শাল পাড়, চন্দ্র পাড়, চন্দ্রহার, হংস, ঝুমকা, কাউয়ার ঠ্যাঙা পাড়, চালতা পাড়, ইঞ্চি পাড় বিলাই আড়াকুল নকশা, কচুপাতা পাড়, বাড়গাট পাড়, করলাপাড়, গিলা পাড়, কলসফুল, মুরালি জাল, কচি পাড়, মিহিন পাড়, কাঁকড়া পাড়, শামুকবুটি, প্রজাপতি বুটি, বেলপাতা পাড়, জবাফুল, বাদুড় পাখি পাড় ইত্যাদি। তবে বর্তমানে শাড়ির জমিনে গোলাপফুল, জুঁইফুল, পদ্মফুল, কলারফানা, আদারফানা, সাবুদানা ইত্যাদি নকশা করা হয়। সাম্প্রতিক সময়ে ঐতিহ্যবাহী জামদানি নকশাকে পুনরুজ্জীবিত করার প্রয়াস চলছে। ছোট ছোট বিভিন্ন ফুলের বুটি তোলা জামদানি বুটিদার নামে পরিচিত। জামদানি বস্ত্রে ছোট ছোট ফুলগুলি যদি তেরছাভাবে সারিবদ্ধ থাকে তাকে তেরছা জামদানি বলে। নকশা শুধু যে ফুল দিয়েই হবে তা নয়, ময়ূর বা লতাপাতা দিয়েও হতে পারে। ফুল, লতার বুটি জাল বুননের মতো সমস্ত জমিনে থাকলে তাকে জালার নকশা বলা হয়। সারা জমিনে সারিবদ্ধ ফুলকাটা জামদানি ফুলওয়ার নামে পরিচিত। 

জামদানির যত্নঃ

জামদানি শাড়ি যেমন অনেক আরামদায়ক বুননে তৈরী তেমনি এর যত্নও বেশি করতে হয়।কিছু উপায় জেনে রাখি চলুন-

) যেকোনো শাড়ি কয়েকবার পরিধানের পর ওয়াশ করতে হয়। তবে জামদানি শাড়ি ঘরে বা ড্রাই ওয়াশ করলে তার রঙ নষ্ট হয়ে যেতে পারে। তাই জামদানি শাড়িকে তাঁতীদের কাছেকাটা ওয়াশ দিতে হয়।

)জামদানি শাড়ি কখনো একি ভাজে রাখতে নেই। কারণ ভাজ বরাবর শাড়ি ফেঁসে যেতে পারে।তাই শাড়িকে অন্য শাড়ি বা পাটির সাথে রোল করে রাখতে হবে।

) জামদানি শাড়ির পাড় যাতে নষ্ট হয়ে না যায় বা জুতার সাথে লেগে নষ্ট না হয় সেজন্য ফলস পাড় লাগিয়ে নিন।

)মাঝেমাঝে রোদে শুকাতে দিন। তবে কড়া রোদে নয়। রোদে দিতে না পারলেও বাতাসে শুকিয়ে নিন।

)জামদানি শাড়িতে পানি ছোঁয়ানো বারণ। যদি বেশি ময়লা হয় তাহলে হালকা ড্রাই ওয়াশ করাতে  পারেন যাতে রঙ নষ্ট না হয়।

)জামদানি শাড়ি তুলে রাখলে নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। তাই মাঝেমাঝে নামিয়ে পড়া উচিত।

) আপনার জামদানি শাড়িটি যদি কিছুটা নরম মনে হয় তাহলে তাঁতীদের কাছে কাটিং করাতে দিন। ১০-১৫দিন সময় লাগতে পারে। ওরা আপনার শাড়িকে পুনরায় নতুনের মতো করে দিবে এবং শাড়িটি আরো কিছুদিন ভালো থাকবে।

 


বর্তমানে নতুন প্রজন্মের কাছে জামদানির ঐতিহ্যকে তুলে ধরতে সচেষ্ট হয়েছে অনেক বুটিক বা ফ্যাশন হাউসগুলো। অনেক নতুন উদ্যোক্তারা অনলাইনে কাজ করছেন জামদানি নিয়ে।